Kanan Devi, the Evergreen Movie Queen
পঙ্কে জন্মে যাহা = পঙ্কজ ... কাননকে বলা যায় পঙ্কজিনী ... হাওড়ার অখ্যাত বা কুখ্যাত পল্লী , নাম ঘোলাডাঙ্গা, এখানেই একটি বাড়িতে জন্ম এবং বড় হওয়া কাননবালার .. কেমন বাড়ি সেটা ? বারো ঘর এক উঠান ... এক বাড়ি, অনেক বাসিন্দা , মহিলারাই ভাড়াটে , একটি একটি করে ঘর , দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে যে জায়গা , জেগে ওঠে রাত্রে ... তেমনি এক বাড়ি ছিল কাননবালার মায়ের.. মায়ের নাম রাজবালা , বাবা রতন চন্দ্র দাস এই রাজবালারই নিয়মিত অতিথি .. বহুদিনের যোগাযোগের ফলে প্রায় স্বামী স্ত্রীর মতন সম্পর্ক ...
রতন চন্দ্রের সামান্য চাকরি , ছোট একটা দোকানের মালিক , বদ অভ্যাস অনেক .. নানা জায়গায় ধার দেনা করে দেহ রাখেন অসময়ে ... কিন্তু রাজবালা সেই দেনার দায় তুলে নেন নিজের ঘাড়ে .. ঘটি বাটি বিক্রি করেও ঋণমুক্ত হন , তারপর শিশু কাননকে নিয়ে পথে নামেন .... কেন ? ওনার নিজের ব্যবসা চালিয়ে গেলেই তো হতো ...সম্ভবত কাননকে ওই কাজে নামাতে চান নি বলেই বেরিয়ে আসা… কোথায় আশ্রয় পেলেন রাজবালা ? তাঁর মেয়েকে নিয়ে ? এমন একজনের কাছে, যাকে বড় করেছেন তিনি , মানুষ করেছেন .. নাম অমিয়া ... কানন এঁকে ডাকতেন দিদি বলে-সেযুগে অমন অনেক হতো ...একজন তাঁর মেয়েকে আরেকজনের হাতে দিয়ে কোথাও চলে যেতেন.. তা এই ভদ্রমহিলা অমিয়া সেরকম একজন, তাঁর মা তাকে বন্ধুস্থানীয়া রাজবালার কাছে ছেড়ে গেছিলেন.. রাজবালা তাঁকে বড় করেন , একটা সমন্ধও করে দেন যেখানে ভীম সিংহ নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের কাছে অমিয়া থাকতেন তাঁর স্ত্রী রূপে ... অমিয়ার কাছে আশ্রয় পেলেন কানন আর তাঁর মা কিন্তু এখানে তাঁদের কাজ পড়লো চাকর বাকরের মতন .. এইখানেই একদিন চূড়ান্ত অপমানের পর কানন তাঁর মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে যান ... অমিয়া ভীম সিংয়ের সঙ্গে থাকতেন চন্দননগরে- সেখান থেকে মাকে নিয়ে গঙ্গা পার হয়ে কানন একেবারে কলকাতায় …. এবার ঠিকানা কলকাতায়.. কালীঘাট অঞ্চলে .. গণেশ কাটরাতে .. এখানেই আসতেন তুলসী বন্দোপাধ্যায় ... তিনি নাট্যজগতের মানুষ ... কানন এঁকে কাকাবাবু বলে ডাকতেন ... এই তুলসী বাবুই কাননকে নিয়ে আসেন সিনেমার জগতে ... ছবির নাম জয়দেব ... রিলিজ ১৯২৬ ... সিনেমা কি, শিল্প কি এসব বোঝার বয়স তখন হয়নি কাননের .. খেতে পাওয়া যাবে, পড়তে পাওয়া যাবে -এইটুকুই বুঝেছিলো সেদিনের বাছা মেয়েটি ... আরেকটা মজা ছিল .. শুটিংয়ে যেতে কালীঘাট থেকে ট্রামে চড়ে যেতে হতো- এই ট্রাম রাইড ভারী পছন্দ ছিল কাননের …. এইভাবেই ফিল্ম জগতে কানন দেবীর পদার্পন ..
তারপর এগিয়ে চলা .. শুধুই এগিয়ে চলা ... সামান্য সিনেমার মেয়েছেলে থেকে আস্তে আস্তে হয়ে ওঠা- স্তরের মর্যাদা- গায়িকার মর্যাদা- একেবারে ভারতজোড়া নম্বর ওয়ান হয়ে ওঠা.. পথের শেষ যেদিন, সেদিন ওঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে বিখ্যাত পরিচালকের উক্তি "বাংলা সিনেমা আজ সত্যিই মাতৃহারা হলো "

১৯২৬এ জয়দেব আর ১৯২৭এ শঙ্করাচার্য-এর পর বছর চারেক কেটে গেছে ... এর মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে অবস্থার ... .. দুটি ছবির পর ডাক এলো অন্য জায়গা থেকে .. কলের গান তৈরী করেন ওরা.. নাম গ্রামোফোন কোম্পানি ... এইচ. এম. ভি. .. মস্ত বড় বিলিতি কোম্পানি ... সেই ঘোলাডাঙ্গাতেই দেখে গেছিলেন এক মজার মানুষ-গান করেন , গান বাঁধেন, মুখে মুখে করেন এসব-সেই তিনি আর তাঁর বন্ধুরা-হীরেন বাবু, ধীরেন বাবু, এঁরা দুজন -দু বছরে তিন খানি রেকর্ড.. সঙ্গে এক নিশ্চিন্ত আশ্রয় … এই আশ্রয়টি স্বদেশী মেগাফোনে কোম্পানিতে- মালিক শ্রী জে. এন. ঘোষ কাননের থাকবার জায়গা করে দিলেন কাননকে.. কোম্পানির বাড়িতেই ... সেখানে গান শেখ শুরু হলো ভীষ্মদেব, জ্ঞান দত্ত, বিনোদ বিহারি গাঙ্গুলি এঁদের কাছে... কঠোর শাসন. কঠিন রেওয়াজ.. ঘন্টার পর ঘন্টা.. কোনো ফাঁকি নেই .. কোনো বিশ্রাম নেই .. এখানে থাকাটাও সম্মানের.. মাঝে মাঝে আঁচ লাগে যদিও-একদিন পিতৃপ্রতীম ভীষ্মদেব টিফিন আনতে ভুলে গেছেন, তা কাননের ঘরে ভাত তৈরী ছিল, সেই খাবার সংগীত-গুরুকে দিতে চাইলে উনি বলে ফেললেন "ওই বেশ্যের ভাত খাবো ? " .. এমন টুকিটাকি নানা কথা- এগুলি গায়ে মাখলে কাননের এগোনো হয়না-তাই গায়ে মাখে না .. শিখতে এসেছে , গান শিখে যায় ...
ফিল্ম ষ্টুডিওতেও কাজের ডাক আসে .. সেই মাদান কোম্পানিতেই-যারা প্রথম সুযোগ দিয়েছিলো, সেই কোম্পানি .. কিন্তু এবার আর শিশু শিল্পী নয়, একেবারে ছবির নায়িকা ১৯৩১-ফিল্মের নাম জোর বরাত- বরাত খুলেই গেলো মেয়েটির .. একের পর এক ছবিতে কাজে ..কিন্তু মাদান কোম্পানিতে কিছু অভদ্র নায়ক-পরিচালক যথেষ্ট পীড়া দেয় কাননকে-অনেক কৌশলে অনেক চেষ্টায় এঁদের অত্যাচারের, এঁদের ভয় দেখানোর হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে মেয়েটি... কিছু পুরুষ মানুষের অগাধ সাহসের অবশ্য কারণ একটা ছিল- অভিনেত্রীরা তখন শিক্ষিত হওয়া দূরের কথা, অক্ষর পরিচিতও হতেন না-এঁরা বেশি ভাগ আসতেন সমাজের বাইরে থেকেই-তাই সহজেই পুরুষের ফাঁদে পা দিয়ে কিছুদিনের জন্য হলেও একটা সংসার গড়ে নিতেন, যা দুদিন পরে ভাঙতো, তখন আবার নতুন বন্ধু, নতুন সংসারের খোঁজ শুরু হতো-কানন নিজেও কিন্তু সমাজের বাইরে থেকেই এসেছিলো-একটা তফাৎ অন্যদের থেকে ছিল-সেটা হলো বড় হওয়ার একটা পণ, একটা জেদ যে তাকে জিততে হবে- হেরে গিয়ে সেই খোলার ঘরে, পরের আশ্রয়ে আর নয়- তাই যখন কিছু মানুষ কাননের এই দিকটা না বুঝেই এগিয়ে এসেছিলো অসীম সাহসে, কাননও তাদের চমকে দিতে, ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলো তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর দৃঢ় চরিত্র দিয়ে-ফল ভালো হয়নি-নালিশ হয়েছিল-কানন নাকি ক্যামেরা ফ্রি নয়, অভিনয়ের কিছুই জানে না, অভিনয় করতেই পারেনা-লাভ হয়নি নালিশে- কেন না জোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি শিশু কাননকে ডাইরেক্ট করেছিলেন জয়দেব ছবিতে, তিনি কোনো নালিশ কারো কাছে শুনতে চান নি- পুরো সমর্থন দিয়েছিলেন কাননকেই ... ১৯৩৩ শ্রীগৌরাঙ্গ ছবি, রাধা ফিল্মের সঙ্গে চুক্তি-মাথার উপর কিছুটা মুক্ত আকাশ বাতাস.. অভিনেত্রী হিসেবে গায়িকা হিসেবে কিছু নাম-তাই ভয় অনেক কম-শ্রীগৌরাঙ্গ ছবিটির হিন্দি ভার্সন হরিভক্তি-তেও নায়িকা বিষ্ণুপ্রিয়া হলেন কানন ... পা পড়লো হিন্দি ছবির জগতেও... হিন্দি ছবিতে কাজে করা মানে পুরো দেশে পরিচিত হওয়া- সাফল্য তো আসছিলো - স্টুডিওতে যারা " এই মেয়ে " বা “এই ছুঁড়ি " বলে ডাকতেন তারা একটু একটু করে সন্ত্রস্ত হলেন ... হটাৎ কথা থেকে যেন ম্যাডাম ডাকটি এসে পড়লো .. তখন থেকে কাননবালা ম্যাডাম বলে ষ্টুডিও পারে পরিচিত .. তখনকার দিনে উনি একমাত্র ম্যাডাম ..
১৯৩৪ .. এলো মা .. ব্রজরাণীর চরিত্রে কাননের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা হলো.. উগ্র, অতি আধুনিক, গর্বিতা মহিলার ভূমিকায় কাননকে মানালো দারুন .. কাননবালা এগিয়ে গেলেন অন্য অভিনেত্রীদের তুলনায় কিছুটা, যদিও সেই সময়ে নম্বর ওয়ান বা নম্বর টু বলে ভাবা হতোনা .. যাকে যেটা মানাবে মনে হতো, তাকে সেই ভূমিকা দেওয়া হতো .. ১৯৩৫ মানময়ী গার্লস স্কুল .. দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা .. পন্ডিত রবিশঙ্কর তখন যুবক, উনি নিজেই লিখেছেন যে উনি পাগল হয়ে গেছিলেন সেদিনের কাননবালাকে দেখে.. এই প্রথম কাননবালার রেকর্ড বেরোলো ফিল্মের গানের-এর আগে বেসিক রেকর্ড অনেক থাকলেও ফিল্মের গানের রেকর্ড এই প্রথম .. মা ছবিটি ১৯৩৬এ হিন্দিতে হলো .. সারা দেশে পরিচিতি পেলো কাননবালার নাম- একটি বেস্ট এক্ট্রেস পুরস্কারও পেয়েছিলেন- ঠিক কারা এই সম্মান দিয়েছিলো সেটা অবশ্য বলতে পারছিনা ..

পায়ের তলায় মাটি পাওয়া গেলো এতদিন পর... মানময়ী গার্লস স্কুলের পরে... কিছু সচ্ছলতা তো এলোই-বাড়ি ভাড়া করে থাকা, পেট ভরে খাওয়া এমনকি গানের জন্য মাস্টার নিযুক্ত করা এসব হলো ... কাননের কিন্তু সন্তুষ্টি নেই.. তাই ইংলিশ শেখবার জন্য মিস্ট্রেস এলেন, শুরু করলেন একেবারে ফার্স্ট বুক থেকে ... লাহোর থেকে ডাক এলো ফিল্মের জন্য এই সময়েই-একটু দোনা মোনা হলো বৈকি-কিন্তু তারপর সেই সিদ্ধান্ত-কলকাতা ছেড়ে কোথাও নয় ... এই সময় স্টুডিওতে অন্য মেয়েরা (অল্পবয়সী অভিনেত্রীরা) যখন নানা গল্প গুজবে মশগুল থাকতেন, দেখা যেত কানন নিজের মনে বই খাতা নিয়ে কোনো একটি গাছতলায় বসে পড়া করে যাচ্ছে .. আবার ডাক পড়লে ছবির শট দিয়ে আসছে....
এর পরের ডাক এলো বড় জায়গা থেকে ... নিউ থিয়েটার্স-স্বপ্নের জায়গা .. একসঙ্গে দুটি ছবি বা বলা ভালো চারটি ছবি কেননা ছবিগুলি ডাবল ভার্সন-যেমন হতো নিউ থিয়েটার্স-এ .. মুক্তি // বিদ্যাপতি .. বিদ্যাপতির কাজ আগে শুরু হলেও ১৯৩৭-এ আগে রিলিজ করলো মুক্তি .. আজ সবার রঙে রং মিশাতে হবে .. এই রবীন্দ্রসংগীতের মধ্য দিয়ে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লো রবীন্দ্রনাথের গান .. অন্য গানগুলিও সুপারহিট .. বাংলা-হিন্দি দুই ভাষাতেই .. ফলে ভারতজোড়া খ্যাতি, বিপুল জনপ্রিয়তা যা আরও শতগুনে বাড়লো বিদ্যাপতি ছবির মাধ্যমে .. বিদ্যাপতির গানও সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিলো.. কাননবালার নাম একেবারে হাউসহোল্ড name হয়ে গেলো .. তৈরী হলো একটি বিশাল ফ্যান following এবং সেটা দেশ জোড়া- কেননা হিন্দি ছবির মাধ্যমে পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা কোনোটাই বাঁধা থাকলো না বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে .. অপর কোনো শিল্পীর ভাগ্যে ঠিক এমনটি হয়নি তখনও .. কানন থাকলে সেই ছবি দেখতে হবে-এই জিনিসের শুরু এই সময় থেকেই .. এই জায়গায় এসে কাননবালার কাজ করবার সুযোগ হলো পি.সি.বি. ,দেবকীবাবু, হেমচন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে.. অন্যদিকে রাই বাবু, পঙ্কজ বাবু এঁদের কাছেও শেখ হলো অনেক .. এলেন কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে , যদিও কাজী সাহেব পূর্ব পরিচিত ... নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিলো কাননের গান ... ওঁর রেকর্ডের বিক্রি ভাঙতে বসলো সব রেকর্ড ... কানন অভিনীত ছবিগুলোকে কানন দেবীর ছবি বলতো মানুষ .. হ্যাঁ, নিউ থিয়েটার্স থেকেই কাননবালা নাম সরে গিয়ে ফিল্মে আর রেকর্ডে লেখা হতে লাগলো কানন দেবী .. যেন সিন্ডারেলার গল্প- তবে কোনোও fairy godmother এর সাহায্যে হয়নি এই উত্তরণ.. সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় হয়েছিল ... নাকি বলা যায় eliza dolittle ? সেখানেও কিন্তু কোনোও Professor Higgins ছিলেন না .. সবটাই নিজের চেষ্টা, নিজের প্রানপন চেষ্টায় নিজেকে ওপরে, আরও ওপরে তুলে ধরা , উঠিয়ে নেওয়া .. জন্ম যেমনই হোক, কর্মেই পরিচয় তাঁর ...

নাম হলো.. যশ হলো .. অর্থ এলো, আসতেই থাকলো ... ফিল্ম কোম্পানি তখন আর কাননকে মাস মাইনের বাঁধা আর্টিস্ট করে রাখলেন না .. ফিল্ম প্রতি চুক্তি- এছাড়াও ফিল্মের লাভের একটি বড় ভাগ … এর আগে এসব হয়নি .. আর গানের রেকর্ড বিক্রি ? কোয়ার্টারলি পঁচিশ হাজার টাকা .. দিনের পর দিন .. সেটা চল্লিশের দশকে শুরু ... কাননের ছবি দেখতে, কাননের গান শুনতে তখন পাগল আসমুদ্র হিমাচল .. একেবারেই তাই- সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী- ঘরে ঘরে তার নাম- ঘরে ঘরে কলের গানে তার গান ... বম্বে টকিজ তাঁকে পাঁচ লক্ষ টাকার চেক দিয়ে বছরে তাদের সঙ্গে একটি ছবি করবার অনুরোধ করলো- কেন ডাকবে না বম্বে ? তখনকার দিনে কাননের একখানি ফটোগ্রাফার-এর জন্য মারামারি .. বিদেশ থেকে প্রকাশিত নানা পণ্যের বইতে কাননের ছবি- বিস্কুট, চকোলেটের কভার বক্সে কাননের ছবি .. এতটা চাহিদা সব স্টারের হয়না- তাই বারবার ডাক আসে- কিন্তু গেলেন না কানন .. যা পাওয়ার , যা না পাওয়ার সব কলকাতাতেই হোক .. বেশ কিছুদিন পর .. বম্বে থেকে প্রযোজক আবার ডাকলেন কাননকে ... কানন তো গেলেন না, বরং বলে পাঠালেন যে ওঁকে নিয়ে ছবি করতে হলে প্রোডিউসার যেন ছবিটি কলকাতাতেই তোলেন .. অবাক হবার মতো কথা.. প্রোডিউসার রাজি হলেন এবং কলকাতায় তৈরী হলো কৃষ্ণলীলা (১৯৪৬) .. ইন্ডাস্ট্রির ওপর এতখানি হোল্ড , এতটা কমান্ডিং হওয়া .. ভাবা যায় কি ?
ষ্টার তাঁকে সেদিনও বলা হত- অনেক পরে তাঁকে সুপার স্টারের position দেওয়া হয় .. কিন্তু এসবের বাইরে তিনি একজন perfect artiste ছিলেন, সেই বৃত্তের বাইরে আবার একজন অত্যন্ত ভালো, সংবেদনশীল মানুষ ... সেই কথা পরে ....

পাওয়া হয়েছিল অনেক ... কিন্তু অভাবও ছিল .. সেটা সামাজিক স্বীকৃতির ... এবার এলো তাও ..
কি ভাবে ? এক বড়লোকের ছেলে .. আর flamboyant in nature .. .. বড্ড ভক্ত কাননবালার .. থাকেন কলকাতার বাইরে তবে আসেন মাঝে মাঝেই কলকাতায়.. এই সময়টা কেটে যায় বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করতেই ... একবার এরকম একটি নৈশ adventure-এ উনি সম্পূর্ণ সুরার দখলে , বন্ধুরা মজা করলেন একটু - অশোকবাবুকে সোজা তুলে এনে কাননের কপালিতলা লেনের বাড়ির সামনে এনে শুইয়ে রেখে চলে গেলো .. ভোরবেলা বাড়ির দরজা খুলে কানন অবাক-কে শুয়ে আছে এমনভাবে ? কথাও বলছেনা .... " কে আপনি ? এখানে কেন ? কি চাই ? " .. প্রশ্ন করেও জবাব নেই কেননা নেশার ঘরে পুরুষটি একেবারেই অচেতন তখনও- এইরকম নাটকীয় ভাবেই অশোক মৈত্র আর কানন দেবীর প্রথম পরিচয় .. পরে প্রেম .. আরও পরে বিবাহ .. এই প্রথম কাননের সামাজিক সীকৃতি মিললো .. টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি খ্যাতির বাইরে আরেকটা অত্যন্ত জরুরি একটা পরিচয় ..
কলকাতার ফিল্ম রিপোর্টারেরা বেশ মজাই করেছিলেন..তাঁরা লিখলেন পত্রিকায় ... " স্টুডিওর আকাশে বাতাসে জোর গুজব যে আমাদের অতি প্রিয় শ্রীমতি কানন নাকি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে চলিয়াছেন , কিন্তু খবরটির সত্যাসত্য শ্রীমতীর নিকট হইতে যাচাই করা হয় নাই .. স্টুডিওতে কোনোও ভাবেই কথা হইতে পাইলো না .. আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুরা যুক্তি করিলাম যে একদিন শ্রীমতীর বসতবাটিতে হানা দিতে হইবে .. যে কথা সেই কাজ .. সদলবলে আমরা এক দুপুরবেলায় শ্রীমতীর দরজায় টোকা দিলাম .. কানন অবাক হইলেন .. হাসিমুখে অভর্থনাও করিলেন কিন্তু যাহা জানিতে যাওয়া তাহার কিছুই জানা হইলো না .. শ্রীমতি কানন একে সুন্দরী, আবার সুরসিকা, আমাদের এতগুলি সাংবাদিককে সুন্দর মুখের হাসিতেই ঘায়েল করিলেন , অবশ্য প্রচুর জলযোগও করাইলেন , কিন্তু বিফল মনোরথ হইয়াই ফিরিতে হইলো “ .. প্রেমের বিয়ে হলেও এই বিয়ে কিন্তু টেঁকে নি...
পরে কানন বিয়ে করেন হরিদাস ভট্টাচার্জি-কে ...

একটি দামি চায়ের কাপ ভেঙে ফেলার অপরাধে প্রচুর গঞ্জনা... ফলে বছর দশের একটি মেয়ের তার মায়ের হাত ধরে পথে বেরিয়ে যাওয়া- এটা একটা দৃশ্য... আবার অনেক পরের আরেকটি দৃশ্য-সেই মেয়েটি তখন মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা .. রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডুর পাশে বসে একটি ক্রিকেট ব্যাট নিলাম করছেন ..
আরেকটি দৃশ্য ... মঞ্চের উপর অনেক বিশিষ্টজন, তাঁদের মধ্যে রাজ্যপাল ধর্মবীরা- মঞ্চে একটু দেরিতেই প্রবেশ করলেন এক ভদ্রমহিলা- "আয়িয়ে কানন দেবীজী " বলে উঠে দাঁড়ালেন রাজ্যপাল- প্রথম নাগরিক উঠে দাঁড়িয়েছেন , তাই উপস্থিত অন্য সকলেও উঠে দাঁড়ালেন... অন্য কোনোও ফিল্ম স্টারের ভাগ্যে এতখানি সম্মান জুটেছে কখনো ? মনে হয়না ... তাই কানন দেবীকে শুধু ফিল্ম ষ্টার ভাবলে অন্যায় হয় .. ঘোলাডাঙ্গা বস্তির সেই মেয়েটি উত্তরিত হতে হতে স্বীয় সাধনার দৌলতে এক মহিয়সী মহিলা- সেখানে কোনোও ফাঁকি নেই-ডানে, ধ্যানে ভক্তিতে আর ভালোবাসা বিতরণে কানন দেবী সকলের অগ্রণী.... তাই সকলের শ্রদ্ধেয়া ...
অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নিলেও ফিল্ম জগৎ থেকে কোনোও দিনই কানন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন নি ... প্রযোজক হয়েছেন- Calcutta movietone ওনার নিজস্ব ষ্টুডিও.. বহু ফিল্ম নির্মিত হয়েছে এখানে.. সেই ষ্টুডিও যখন বয়সের ভারে আর না চালিয়ে বিক্রি করে দেন তখন এমন শর্ত রেখেছিলেন ডিডের মধ্যে যে ওনার পরে যিনিই মালিক হয়েছেন সেই বিশাল সম্পত্তির, তাঁকেই কিন্তু শুধু ফিল্ম নির্মাণের কাজেই ব্যবহার করতে পেরেছেন ওই জায়গা .. কোনোও মাল্টি স্টোরি এপার্টমেন্ট সেই জায়গায় হতে পারে নি ... দুস্থ শিল্পীদের সাহায্য কল্পে গড়েছিলেন মহিলা শিল্পী মহল- এঁরা সারা বাঙলায় নাটকের শো করে অর্থ উপার্জন করতেন এবং বহু দুস্থ শিল্পীকে সাহায্য করতেন .. ভারতে এই ধরণের প্রয়াস কানন দেবীর পরিচালনাতেই প্রথম হয়েছিল ..
প্রথম দিকের একজন ফিল্ম এক্ট্রেস মাত্র , বছর তিনেকের মধ্যে যিনি নিজের আলাদা পরিচয় করে নিতে পেরেছিলেন আর তারপর হয়ে উঠলেন বাংলার (শুধু বাংলার কেন অল ইন্ডিয়া , তবে কিনা বোম্বেবের অনেকে মানতে চান না ) প্রথম গ্ল্যামার ষ্টার , তারপর ধাপে ধাপে হয়ে উঠলেন বাংলা সিনেমায় একটা mother figure ... ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে কেউ গেছেন ওনার কাছে , খালি হাতে ফেরেন নি .. এর মানে অর্থ সাহায্য নয় , যে কোনো রকম সাহায্য যা তিনি করতে পারতেন তা করেছেন .. বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মা বলেছেন তাঁকে অনেকে ... সেটা শুধু মুখের কথা ছিল না .. এই জায়গাটা সত্যি তিনি নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছিলেন …. সেই জায়গায় আর কেউ এসে দাঁড়াতে পারেন নি .. ভবিষ্যতে আসবেন , এমন তো দেখে মনে হয়না ...
তখন আমি দিল্লিতে ... খবর পেলাম সেই বছরেও আমি BFJA বেস্ট এক্টর পুরস্কার পাচ্ছি .. খুশি হলেন কিন্তু আরোও খুশি হলাম যখন সেদিনই জানলাম যে আমাদের সবার প্রিয় কানন দেবী সেই বছর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাচ্ছেন .....

কানন দেবীকে নিয়ে সরকারি তরফে কোনোও ডকুমেন্টারী তোলা হয়নি, যদিও প্রস্তাব ছিল ..১৯৮০ সাল.. ফিল্মস ডিভিশনের কলকাতা অফিস থেকে অঞ্জন বসুকে পাঠানো হয়েছিল কাননের বাড়িতে.. . তথ্যচিত্রের প্রস্তাব অনুমোদন করতে কেননা জীবিত কোনো ব্যক্তির ওপর তথ্যচিত্র- সরকারি হোক বা বেসরকারি, সেই মানুষটির অনুমতি লাগতো বা এখনো লাগে.... যাই হোক নির্ধারিত দিনে অঞ্জনবাবু পৌঁছে যান কাননের বাড়িতে.. কানন মাটিতে বসে তরকারি কাটছিলেন.. হরিদাস বাবু ছিলেন কাছেই বসে.. কাননের সময়কার শুটিংয়ের নানা খুঁটিনাটি, নানা সমস্যা নিয়েই মূলত প্রথম দিকে কথা হয়েছিল.. কিছুক্ষন কথা চলার পরে কানন উঠে গিয়ে নিজে হাতে করেই জল, মিষ্টি নিয়ে এলেন অঞ্জন বাবুর জন্য.. এরপর অঞ্জনবাবু কথা পারলেন তথ্যচিত্র নির্মাণের অনুমতির জন্য.. কানন কিন্তু অস্বীকার করলেন.. বললেন " বাবা, আপনি যদি এই ছবি করেন তাহলে এমন অনেক মানুষের সমন্ধে আমাকে অনেক কটুকথা বলতে হবে, যা আমি আমার জীবন থাকতে করতে পারবো না.. ওনারা আমায় অসম্মান করেছেন, তাই বলে আমি তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবোনা'.... এমন মানুষই ছিলেন.. ইন্ডাস্ট্রির মাথায় তখন তিনি, কিন্তু কুৎসা করতে রাজি নন.....
আরেকটি গল্প.... ১৯৫৪ সাল নাগাদ... শরৎচন্দ্রের নব বিধান তৈরির সময়.. শ্রীমতি পিকচার্স এর অফিস কাননের বাড়িতেই, টালিগঞ্জে... একদিন সকাল দশটা নাগাদ একটা ফোন এলো ..ফোন তুলেই বিব্রত কানন, কথা সেরে নিয়ে বেশ আতংকিত ভাবে বললেন তাড়াতাড়ি তাঁর হারমোনিয়ামটি এনে দিতে.. নিজের বাড়িতে রেওয়াজ করতেন না তেমন কোনোদিন .. তাই ওটা খুঁজতে সময় লাগলো কিছু.. কি ব্যাপার ? না বাঘ আসছে বিকেলের দিকে….. কে বাঘ ? না কমল দাসগুপ্ত....কানন যে ছবির প্রোডিউসার-নায়িকা , সেই ছবি নববিধানের সংগীত পরিচালক.. সন্ধ্যা নাগাদ গাড়ি থেকে নামলেন কমল বাবু.... বেশ খিটখিটে মেজাজ..কাঠখোট্টা ভঙ্গি... এঁরই সুরে কানন একের পর এক হিট গান শুনিয়েছেন সারা ভারতবাসীকে.... কিন্তু ষ্টার অফ স্টার্স কাননের ব্যবহারটি কিন্তু নতুন ছাত্রীর মতোই.... কমল দাসগুপ্ত যন্ত্রে, সামনেই কানন, বাধ্য ছাত্রীটি .. থেকে থেকেই ধমক খাচ্ছেন আর নির্বিবাদে হজম করে নিচ্ছেন সেই সব এক ঘর লোকের সামনে..... তিনি ছবির প্রযোজক, তিনি ছবির নায়িকা, তিনি দেশের এক নম্বর ষ্টার.. কিন্তু কানন যে কাননই-তাঁর কাছে শেখার কোনো শেষ নেই... ..তাঁর কাছে জীবন মানেই শেখ, আরো শিখে যাওয়া , লড়াই করে আরো ওপরে ওঠা...

১৯৬১ সাল ... রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ .. সেই সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সরকার বাহাদুর অধিগ্রহণ করেন- এখানেই এখন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়- অধিগ্রহনের আগের কথা... কলিকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যান শৈবাল গুপ্ত গাড়ি করে যাচ্ছিলেন ঠাকুরবাড়ির পাশ দিয়ে-বাড়ি ভাঙার শব্দে উনি গাড়ি থামান এবং আরও কাছে এসে দেখেন যে কবিগুরুর বসতবাড়ির একাংশ ভাঙা হচ্ছে-বাড়িটির মালিক কিন্তু গুরুদেব একা ছিলেন না, কেননা মহর্ষির সব সন্তানেরই ভাগ ছিল ওই বাড়িতে-তাঁদেরই কেউ নিজের অংশ বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক মাড়োয়ারির কাছে- সেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোক সেদিন বাড়ি ভাঙা শুরু করেছিলেন-ওনার দুর্ভাগ্য তখনই শৈবাল বাবু যাচ্ছিলেন- শৈবাল বাবু ওই নতুন বাড়িওয়ালাকে কাজ বন্ধ করতে বলেন কিন্তু নতুন মালিক শুনবেন কেন ? জানিয়ে দেন তিনি যে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে সম্পত্তি কিনেছেন, অতএব তাঁর ইচ্ছেমতোই তিনি ভাঙাচোরা করবেন- ব্যবসার কাজে লাগাবেন ওই জায়গা- প্রথমে কিছু তর্ক-বিতর্কের পর শৈবাল বাবু নিজের পরিচয় দিয়ে সোজাসুজি ভাঙ্গনের কর্মীদের নির্দেশ দিলেন কিছু সময়ের জন্য কাজ বন্ধ করতে- মাড়োয়ারি ভদ্রলোক তখন কিছু নিস্তেজ-শৈবাল বাবু গাড়িতে উঠে বসলেন আর কিছুক্ষন নিজের সঙ্গেই নিজে আলোচনা করে সোজা রওয়ানা দিলেন টলিগঞ্জের দিকে- হ্যাঁ, কানন দেবীর বাড়ির দিকে.....
সূর্যনগরের বাড়িতে অধীর ভাবে অপেক্ষা করছেন.. কানন এলেন.. শৈবাল বাবু সমস্যার কথা জানালেন- এখুনি কিছু না করতে পারলে গুরুদেবের বাড়ি ভাঙা রাখা যাবে না- " কানন দেবী কি কিছু সাহায্য করতে পারবেন ?"- শৈবাল বাবুকে বসতে বললেন কানন- কিছু পরে ফায়ার এসে তাঁর হাতে তুলে দিলেন একটি চেক ... "এতে হবে ? " কাননের প্রশ্ন- চেক হাতে নিয়ে কথা ফোটে না শৈবাল বাবুর মুখে- কোনোমতে বললেন যে আপনি দিচ্ছেন ? ... কানন বলেন " হ্যাঁ দিচ্ছি- ওনার আশীর্বাদেই আমার গান শোনেন মানুষ , এখন এটা নিন- লাগলে আবার আসবেন " ... আর লাগে নি-তখনকার মতন বাড়ি ভাঙা বন্ধ হলো- তারপর তো সরকারই ভার নিলেন মহর্ষি ভবন অধিগ্রহণ করে....
কত টাকার চেক ছিল ? মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকার.. কাননের পার্সোনাল একাউন্ট থেকে ...
|